সেবার গ্রীষ্মে হঠাত্ করেই ডিসিশন নিলাম ইয়োলোস্টোন যাবো, ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে প্রায় ১৪০০ মাইল (২,২০০ কিমি) দুরে, অন্তত ২০ ঘন্টার ড্রাইভ৷ একটু ঝুকি ছিল দুরত্ব বেশী হওয়ায়, তখন পর্যন্ত এতদুর একটানা ড্রাইভ করি নি৷ একটু খোজাখুজি করতে দুচারজন সঙ্গী জুটে গেল, আমি ছাড়া একজন ছেলে (চাপাতা), তিনজন মেয়ে (সর্ষে, ক্যাপসিকাম, আর টমেটো), আসল নাম দিতে পারলাম না দুঃখিত৷ তখনও ট্র্যাভেল প্ল্যানিং এ ঠিক পেকে উঠিনি, অনেক ওভারএস্টিমেশন ছিল নিজেদের দক্ষতা নিয়ে, বিশেষ করে সময়ের বাফার ছিল খুব কম৷ এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় পুরো ট্রিপটাই অন্যভাবে করা উচিত ছিল৷
সময় সংকোচন করতে গিয়ে রওনা হলাম সন্ধ্যার পর পরই, চাপাতা মেইন ড্রাইভার, আমি ব্যাকআপ, রাতে কম ঝিমাই বলে সুনাম ছিল, সুতরাং ঠিক হলো মাঝরাতের পর থেকে আমি চালাব৷ স্বার্থপর তিন মেয়ে গাড়ি চলা শুরু করার আধ ঘন্টার মধ্যে ভ্যানের পেছনের সিটে ঘুমিয়ে গেল৷ কি আর করা আমরা ছেলে দুজন টুকটাক কথা বলতে লাগলাম, ঘন্টা দুয়েক পরে ড্রাইভার বদলে আমি স্টীয়ারিং এর পেছনে, ততক্ষনে গাড়ির ভেতরটা নিদ্রিতাদের নিঃশ্বাসের শব্দে-গন্ধে বেশ ভারী হয়ে উঠেছে৷ রাত একটার দিকে আমাদের স্টেট পার হয়ে পাশের স্টেটের মোটামুটি সাইজের একটা শহরে পৌছলাম, আর চালাতে পারব না, এখানেই রাতে থাকতে হবে৷ এত রাতে মোটেলওয়ালারা দেখি আকাশচুম্বি ভাড়া চেয়ে বসছে, ঠিক করলাম কি আর করা সবাই একরুমেই থাকব৷
একটা মতলব ছিল মাঝরাতে সবার আগে উঠে একমাত্র বাথরুমটাতে গিয়ে একটু পেট খালি করে নেব, রুমের এটাচড বাথরুম হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে খুব একটা সাউন্ডপ্রুফ না৷ সাতপাচ ভেবে আর ঝুকিটা নিলাম না, যদিও আগ্নেয়গিরি তখন ফুসছে৷ আমাদের সাথের মেয়েরা গতানুগতিক বাঙালী মেয়েদের চেয়ে অনেক চটপটে, অন্তত সময়ের ব্যাপারে, সকালে আমি আড়মোড়া ভাঙ্গতেই দেখি ওরা সেজে গুজে বিছানায় বসে গল্প মারছে৷ আরও ঘন্টাখানেক ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখনও ১০০০ মাইল বাকী, নিজের ওপরই রাগ হলো এত টাইট প্ল্যান করার জন্য৷
মোটেলের ফ্রী মাফিন, আর জুস খেয়ে আমার কাজ হবে না, বের হয়ে ম্যাকডোনাল্ডসে সস্তা মারলাম, তখন তেমন স্বাস্থ্য সচেতন ছিলাম না, সুতরাং ম্যাক আমার ভালই চলতো৷ চাপাতা দেখি সারারাত ঘুমিয়েও আমাকে ড্রাইভ করতে বলে, যদিও মেয়েদের সামনে বীরত্ব ফোটানোর বয়স চলে গেছে, তাও মুখ ফুটে না করতে পারলাম না৷ মেয়েরা দেখি বেশ জলি মুডে আছে, গাড়ি চলতে হাসাহাসি, কথাবার্তা অচিরেই চেচামেচিতে পরিনত হলো৷ এক জায়গায় পড়েছিলাম মেয়েরা গসিপ করে অর্গাজমের সমান মজা পায়, কে জানে, হলেও হতে পারে৷ আর না হলেই কি বেশ মজা যে পাচ্ছে তা তো বোঝাই যায়৷ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের পরচর্চা পর্ব শুনতে৷ পরিচিত, অর্ধ পরিচিত, অপরিচিত বহু কাহিনী শুনলাম৷ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহুত কিছু মিস করেছি আরেকবার উপলব্ধি হল৷
ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ায়োমিঙ (Wyoming) রাজ্যে৷ পার্কটা আসলে পৃথিবীর ক্রাস্টের ভেতরে ভলকানিক হটস্পটের ওপর, বিশাল আকারের একটা ক্যালডেরা (বাংলা অর্থটা মনে করতে পারছি না)৷ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বছর আগে বড় আকারের অগ্ন্যুত্পাতে এই ক্যালডেরা তৈরী হয়েছে, ওরা এজন্য একে বলে “Super Volcano”৷ মাটির নীচে এখনও লাভা থাকায় ইয়োলোস্টোনে অসংখ্য জিওথার্মাল গাইজার (Geysers) এবং উষ্ঞ প্রস্রবন আছে (বিশ্বের ৬২% এখানে)৷ এগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে কিচ্ছুক্ষন পরপর এরা বেশ গরম ফুটন্ত পানি এবং বাষ্প ছুড়ে দিচ্ছে ওপরে৷
মন্টানার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দিগন্তের উত্তর ধার দিয়ে দেখা যাচ্ছিল গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক৷ গ্লোবাল ওয়ার্মিং সত্যি না মিথ্যা এই নিয়ে মিডিয়াতে অনেক তর্ক হয়৷ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা সরাসরি প্রমান গ্লেসিয়ার পার্ক, গত কয়েক দশকে অল্প সময়েই এর বেশীরভাগ গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) গলে গেছে৷ আর কিছুদিন পর গ্লেসিয়ার পার্কে কোন গ্লেসিয়ারই থাকবে না৷ তবুও অপরাহ্নের আলোতে বরফের সাদা টুপী পড়া নীলাভ পর্বতগুলোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল৷
ইয়োলোস্টোনে পৌছুতে পৌছুতে রাত নেমে গেল৷ মাথা ব্যাথায় তখন আমার অবস্থা কাহিল, তাড়াতাড়ি টুকটাক কিছু খেয়ে একটা টাইলেনল (প্যারাসিটামল) খেলাম৷ ট্যুরিস্টে ছেয়ে গেছে আশে পাশের ছোট শহর গুলো৷ এর মধ্যে আমাদের গাড়ি পড়ল একপাল বাইসনের মধ্যে৷ বাইসনগুলো একটু বুঝদার মনে হয়, কারন চাইলে ওরা ভ্যানটাকে উল্টে দিতে পারত, কিন্তু সেরকম চেষ্টা আছে বলে মনে হয় না, ঢিমেতালে ওরা রাস্তা পার হলে ছাড়া পেলাম, আরও অনেক গাড়ি আমাদের মত আটকে ছিল৷ বাইসন কিন্তু উত্তর আমেরিকা থেকে একরকম নিশ্চিহ্নই হয়ে গিয়েছিল, পরে আবার রি-ইন্ট্রোডিউস করা হয়েছে৷ খুজে পেতে সস্তায় একটা মোটেল পাওয়া গেল, গোটা বিশেক ফোন করতে হয়েছে এটা পেতে, আবার সবাই মিলে একরুমে, তবে আজ আমার রাতে বাথরুমে যেতেই হবে, নইলে…
সকালে তাড়াহুড়ো করে সবাই বেড়িয়ে পড়লাম৷ বহু লোক দেখলাম ক্যাম্পিং করছে পার্কের মধ্যেই, অনেকে আবার আরভি নিয়ে এসেছে, বউ-বাল-বাচ্চা সহ৷ পার্কের সাইজ বেশ বড় ৮৮৭৯ বর্গ কিমি, মানে বাংলাদেশের পুরোনো ময়মনসিংহ-জামালপুর জেলার সমান৷ গাইজারগুলো অদ্ভুত, পানি যেমন ফুটন্ত তেমন আবার সালফার মিশ্রিত৷ পুরো জায়গাটা একরকম বারূদের গন্ধে ভরা৷ একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে এত প্রতিকুল পরিবেশেও গাইজার বা উষ্ঞপ্রস্রবন একদম প্রানহীন নয়৷ সালফার খেকো ব্যাক্টেরিয়া বেচে থাকতে পারে এত তাপমাত্রায়৷ এসব ব্যক্টেরিয়ার শক্তির উত্স জিওথার্মাল এনার্জি, যেখানে জীবজগতের বাকী অংশ ঘুরে ফিরে সুর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল৷ পৃথিবী সৃষ্টির আদি অবস্থায় তার মানে এসব ব্যক্টেরিয়ার বেচে থাকতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়, বিশেষত তখন যেহেতু আগ্নেয়গিরি আরও বেশী ছিল৷
রাস্তায় বের হতেই একটু দুরে একটা ভালুক দেখলাম, সম্ভবত ব্ল্যাক বিয়ার৷ দুরবীন না থাকায় খালি চোখে দেখেই সন্তষ্ট হতে হল৷ ভালুককে অবশ্য আবার খুব পছন্দ হয় না, লোক ভালো মনে হয় না ওদের, বরং কিছু পরে একটা কায়োটি (Coyote, শেয়াল টাইপের) দেখে তাড়াতাড়ি অনেক ছবি তুলে নিলাম৷ রাস্তার ধারে প্রংহর্ণ (হরিণ), এল্ক (হরিণ) দেখলাম অনেক, ভালুক বদমাশ মনে হয় এগুলো মেরে খায়৷ হরিন গুলোর অনেকের পশ্চাতদেশ আবার আলাদা রঙের (সাদা), উদ্দ্যেশ্য কি ঠিক বুঝলাম না৷ হরিন সমাজের একটা ব্যপার ভাল লাগলো ছেলে হরিন প্রতি বহু মেয়ে হরিণ আছে (অনেকটা আরবদের মত হারেম পদ্ধতি)৷ গাড়িতে ছেলেরা আমরা দুঃখ করলাম আহারে, মানুষের যদি এমন হত৷
টেকটোনিক প্লেটগুলোর মুভমেন্টের কারনে ইয়োলোস্টোনের আগ্নেয় হটস্পট আসলে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, একসময় একই হটস্পট ছিল আইডাহোর (Idaho) রাজধানী বইসির (Boise) কাছে৷ ইয়োলোস্টোন পার্কের মধ্যেই এই টেকটোনিক প্লেটের কন্টিনেন্টাল ডিভাইড দেখা যায়৷ জিওলজিক এ্যাক্টিভিটির কারনে অনেক জায়গায় স্তরীভুত পাথর উপরে উঠে এসেছে৷ পৃথিবীর ভুতাত্ত্বিক ইতিহাসের একটা সরল পাঠ হয়ে যায় নিজের চোখের সামনে৷ অবশ্য একটা পাথর দেখালাম কি কারনে যেন পুরুষদের মুল্যবান অঙ্গের মতো দেখতে, বহু লোক ছবি তুলছে তার (পাশের ছবি), দলের মেয়েরাও নেচে উঠল, এই পাথরের সাথে ছবি মাস্ট৷
ইয়োলোস্টোনের সবচেয়ে নামকরা গাইজার মনে হয় ওল্ড ফেইথফুল, মোটামুটি প্রতি নব্বই মিনিট পরপর গাইজারটি পানি ছুড়ে মারে৷ ভীড়ের কারনে ঠিকমত ছবি তুলতে পারলাম না, যখন ওল্ড ফেইথফুল ইরাপ্ট করছিল৷ টুকটাক স্যুভেনীর কিনলাম আমরা এর পর৷ আমাদের গাড়ির পর্যটকরা অবশ্য এর মধ্যে বেশ টায়ার্ড, সারাদিন গাইজার, ঝর্না, বাইসন, এল্ক আর ট্যুরিস্ট দেখতে দেখতে৷ আমার প্ল্যানের আরেকটা গুরুত্বপুর্ন ভুল ছিল, ঠিকমতো খাবারের সময় এবং স্থান লিখে না নিয়ে আসা৷ কারন পেটে ক্ষুধা থাকলে পেট্রিফাইড ফরেস্ট বা জুরাসিক-ট্রায়াসিক স্ট্রাটা কোনটাই ভালো লাগে না৷ তাই শেষমেশ দর্শনীয় তালিকার অনেক কিছু বাদ থাকল৷
ফেরার পথটা ছিল বোরিং৷ আমি বেশী বুদ্ধি করতে গিয়ে অল্টারনেট রুট নিলাম, প্রায় দুইঘন্টা নষ্ট হলো ওখানে৷ সারারাত বদলাবদলি করে ড্রাইভ করতে হল৷ ১৪০০ মাইল এখন মনে হচ্ছিল ১৪ হাজার মাইল৷ মেয়েরাও ক্লান্ত হয়ে এখন ঘুমাচ্ছে৷ পরের সারাদিন ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে মনে হল অবশেষে মুক্তি, এখন শুধু গোসল করে দিতে হবে একটা লম্বা ঘুম, তারপর অন্যকথা৷
সময় সংকোচন করতে গিয়ে রওনা হলাম সন্ধ্যার পর পরই, চাপাতা মেইন ড্রাইভার, আমি ব্যাকআপ, রাতে কম ঝিমাই বলে সুনাম ছিল, সুতরাং ঠিক হলো মাঝরাতের পর থেকে আমি চালাব৷ স্বার্থপর তিন মেয়ে গাড়ি চলা শুরু করার আধ ঘন্টার মধ্যে ভ্যানের পেছনের সিটে ঘুমিয়ে গেল৷ কি আর করা আমরা ছেলে দুজন টুকটাক কথা বলতে লাগলাম, ঘন্টা দুয়েক পরে ড্রাইভার বদলে আমি স্টীয়ারিং এর পেছনে, ততক্ষনে গাড়ির ভেতরটা নিদ্রিতাদের নিঃশ্বাসের শব্দে-গন্ধে বেশ ভারী হয়ে উঠেছে৷ রাত একটার দিকে আমাদের স্টেট পার হয়ে পাশের স্টেটের মোটামুটি সাইজের একটা শহরে পৌছলাম, আর চালাতে পারব না, এখানেই রাতে থাকতে হবে৷ এত রাতে মোটেলওয়ালারা দেখি আকাশচুম্বি ভাড়া চেয়ে বসছে, ঠিক করলাম কি আর করা সবাই একরুমেই থাকব৷
একটা মতলব ছিল মাঝরাতে সবার আগে উঠে একমাত্র বাথরুমটাতে গিয়ে একটু পেট খালি করে নেব, রুমের এটাচড বাথরুম হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে খুব একটা সাউন্ডপ্রুফ না৷ সাতপাচ ভেবে আর ঝুকিটা নিলাম না, যদিও আগ্নেয়গিরি তখন ফুসছে৷ আমাদের সাথের মেয়েরা গতানুগতিক বাঙালী মেয়েদের চেয়ে অনেক চটপটে, অন্তত সময়ের ব্যাপারে, সকালে আমি আড়মোড়া ভাঙ্গতেই দেখি ওরা সেজে গুজে বিছানায় বসে গল্প মারছে৷ আরও ঘন্টাখানেক ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখনও ১০০০ মাইল বাকী, নিজের ওপরই রাগ হলো এত টাইট প্ল্যান করার জন্য৷
মোটেলের ফ্রী মাফিন, আর জুস খেয়ে আমার কাজ হবে না, বের হয়ে ম্যাকডোনাল্ডসে সস্তা মারলাম, তখন তেমন স্বাস্থ্য সচেতন ছিলাম না, সুতরাং ম্যাক আমার ভালই চলতো৷ চাপাতা দেখি সারারাত ঘুমিয়েও আমাকে ড্রাইভ করতে বলে, যদিও মেয়েদের সামনে বীরত্ব ফোটানোর বয়স চলে গেছে, তাও মুখ ফুটে না করতে পারলাম না৷ মেয়েরা দেখি বেশ জলি মুডে আছে, গাড়ি চলতে হাসাহাসি, কথাবার্তা অচিরেই চেচামেচিতে পরিনত হলো৷ এক জায়গায় পড়েছিলাম মেয়েরা গসিপ করে অর্গাজমের সমান মজা পায়, কে জানে, হলেও হতে পারে৷ আর না হলেই কি বেশ মজা যে পাচ্ছে তা তো বোঝাই যায়৷ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের পরচর্চা পর্ব শুনতে৷ পরিচিত, অর্ধ পরিচিত, অপরিচিত বহু কাহিনী শুনলাম৷ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহুত কিছু মিস করেছি আরেকবার উপলব্ধি হল৷
ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ায়োমিঙ (Wyoming) রাজ্যে৷ পার্কটা আসলে পৃথিবীর ক্রাস্টের ভেতরে ভলকানিক হটস্পটের ওপর, বিশাল আকারের একটা ক্যালডেরা (বাংলা অর্থটা মনে করতে পারছি না)৷ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বছর আগে বড় আকারের অগ্ন্যুত্পাতে এই ক্যালডেরা তৈরী হয়েছে, ওরা এজন্য একে বলে “Super Volcano”৷ মাটির নীচে এখনও লাভা থাকায় ইয়োলোস্টোনে অসংখ্য জিওথার্মাল গাইজার (Geysers) এবং উষ্ঞ প্রস্রবন আছে (বিশ্বের ৬২% এখানে)৷ এগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে কিচ্ছুক্ষন পরপর এরা বেশ গরম ফুটন্ত পানি এবং বাষ্প ছুড়ে দিচ্ছে ওপরে৷
মন্টানার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দিগন্তের উত্তর ধার দিয়ে দেখা যাচ্ছিল গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক৷ গ্লোবাল ওয়ার্মিং সত্যি না মিথ্যা এই নিয়ে মিডিয়াতে অনেক তর্ক হয়৷ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা সরাসরি প্রমান গ্লেসিয়ার পার্ক, গত কয়েক দশকে অল্প সময়েই এর বেশীরভাগ গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) গলে গেছে৷ আর কিছুদিন পর গ্লেসিয়ার পার্কে কোন গ্লেসিয়ারই থাকবে না৷ তবুও অপরাহ্নের আলোতে বরফের সাদা টুপী পড়া নীলাভ পর্বতগুলোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল৷
ইয়োলোস্টোনে পৌছুতে পৌছুতে রাত নেমে গেল৷ মাথা ব্যাথায় তখন আমার অবস্থা কাহিল, তাড়াতাড়ি টুকটাক কিছু খেয়ে একটা টাইলেনল (প্যারাসিটামল) খেলাম৷ ট্যুরিস্টে ছেয়ে গেছে আশে পাশের ছোট শহর গুলো৷ এর মধ্যে আমাদের গাড়ি পড়ল একপাল বাইসনের মধ্যে৷ বাইসনগুলো একটু বুঝদার মনে হয়, কারন চাইলে ওরা ভ্যানটাকে উল্টে দিতে পারত, কিন্তু সেরকম চেষ্টা আছে বলে মনে হয় না, ঢিমেতালে ওরা রাস্তা পার হলে ছাড়া পেলাম, আরও অনেক গাড়ি আমাদের মত আটকে ছিল৷ বাইসন কিন্তু উত্তর আমেরিকা থেকে একরকম নিশ্চিহ্নই হয়ে গিয়েছিল, পরে আবার রি-ইন্ট্রোডিউস করা হয়েছে৷ খুজে পেতে সস্তায় একটা মোটেল পাওয়া গেল, গোটা বিশেক ফোন করতে হয়েছে এটা পেতে, আবার সবাই মিলে একরুমে, তবে আজ আমার রাতে বাথরুমে যেতেই হবে, নইলে…
সকালে তাড়াহুড়ো করে সবাই বেড়িয়ে পড়লাম৷ বহু লোক দেখলাম ক্যাম্পিং করছে পার্কের মধ্যেই, অনেকে আবার আরভি নিয়ে এসেছে, বউ-বাল-বাচ্চা সহ৷ পার্কের সাইজ বেশ বড় ৮৮৭৯ বর্গ কিমি, মানে বাংলাদেশের পুরোনো ময়মনসিংহ-জামালপুর জেলার সমান৷ গাইজারগুলো অদ্ভুত, পানি যেমন ফুটন্ত তেমন আবার সালফার মিশ্রিত৷ পুরো জায়গাটা একরকম বারূদের গন্ধে ভরা৷ একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে এত প্রতিকুল পরিবেশেও গাইজার বা উষ্ঞপ্রস্রবন একদম প্রানহীন নয়৷ সালফার খেকো ব্যাক্টেরিয়া বেচে থাকতে পারে এত তাপমাত্রায়৷ এসব ব্যক্টেরিয়ার শক্তির উত্স জিওথার্মাল এনার্জি, যেখানে জীবজগতের বাকী অংশ ঘুরে ফিরে সুর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল৷ পৃথিবী সৃষ্টির আদি অবস্থায় তার মানে এসব ব্যক্টেরিয়ার বেচে থাকতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়, বিশেষত তখন যেহেতু আগ্নেয়গিরি আরও বেশী ছিল৷
রাস্তায় বের হতেই একটু দুরে একটা ভালুক দেখলাম, সম্ভবত ব্ল্যাক বিয়ার৷ দুরবীন না থাকায় খালি চোখে দেখেই সন্তষ্ট হতে হল৷ ভালুককে অবশ্য আবার খুব পছন্দ হয় না, লোক ভালো মনে হয় না ওদের, বরং কিছু পরে একটা কায়োটি (Coyote, শেয়াল টাইপের) দেখে তাড়াতাড়ি অনেক ছবি তুলে নিলাম৷ রাস্তার ধারে প্রংহর্ণ (হরিণ), এল্ক (হরিণ) দেখলাম অনেক, ভালুক বদমাশ মনে হয় এগুলো মেরে খায়৷ হরিন গুলোর অনেকের পশ্চাতদেশ আবার আলাদা রঙের (সাদা), উদ্দ্যেশ্য কি ঠিক বুঝলাম না৷ হরিন সমাজের একটা ব্যপার ভাল লাগলো ছেলে হরিন প্রতি বহু মেয়ে হরিণ আছে (অনেকটা আরবদের মত হারেম পদ্ধতি)৷ গাড়িতে ছেলেরা আমরা দুঃখ করলাম আহারে, মানুষের যদি এমন হত৷
টেকটোনিক প্লেটগুলোর মুভমেন্টের কারনে ইয়োলোস্টোনের আগ্নেয় হটস্পট আসলে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, একসময় একই হটস্পট ছিল আইডাহোর (Idaho) রাজধানী বইসির (Boise) কাছে৷ ইয়োলোস্টোন পার্কের মধ্যেই এই টেকটোনিক প্লেটের কন্টিনেন্টাল ডিভাইড দেখা যায়৷ জিওলজিক এ্যাক্টিভিটির কারনে অনেক জায়গায় স্তরীভুত পাথর উপরে উঠে এসেছে৷ পৃথিবীর ভুতাত্ত্বিক ইতিহাসের একটা সরল পাঠ হয়ে যায় নিজের চোখের সামনে৷ অবশ্য একটা পাথর দেখালাম কি কারনে যেন পুরুষদের মুল্যবান অঙ্গের মতো দেখতে, বহু লোক ছবি তুলছে তার (পাশের ছবি), দলের মেয়েরাও নেচে উঠল, এই পাথরের সাথে ছবি মাস্ট৷
ইয়োলোস্টোনের সবচেয়ে নামকরা গাইজার মনে হয় ওল্ড ফেইথফুল, মোটামুটি প্রতি নব্বই মিনিট পরপর গাইজারটি পানি ছুড়ে মারে৷ ভীড়ের কারনে ঠিকমত ছবি তুলতে পারলাম না, যখন ওল্ড ফেইথফুল ইরাপ্ট করছিল৷ টুকটাক স্যুভেনীর কিনলাম আমরা এর পর৷ আমাদের গাড়ির পর্যটকরা অবশ্য এর মধ্যে বেশ টায়ার্ড, সারাদিন গাইজার, ঝর্না, বাইসন, এল্ক আর ট্যুরিস্ট দেখতে দেখতে৷ আমার প্ল্যানের আরেকটা গুরুত্বপুর্ন ভুল ছিল, ঠিকমতো খাবারের সময় এবং স্থান লিখে না নিয়ে আসা৷ কারন পেটে ক্ষুধা থাকলে পেট্রিফাইড ফরেস্ট বা জুরাসিক-ট্রায়াসিক স্ট্রাটা কোনটাই ভালো লাগে না৷ তাই শেষমেশ দর্শনীয় তালিকার অনেক কিছু বাদ থাকল৷
ফেরার পথটা ছিল বোরিং৷ আমি বেশী বুদ্ধি করতে গিয়ে অল্টারনেট রুট নিলাম, প্রায় দুইঘন্টা নষ্ট হলো ওখানে৷ সারারাত বদলাবদলি করে ড্রাইভ করতে হল৷ ১৪০০ মাইল এখন মনে হচ্ছিল ১৪ হাজার মাইল৷ মেয়েরাও ক্লান্ত হয়ে এখন ঘুমাচ্ছে৷ পরের সারাদিন ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে মনে হল অবশেষে মুক্তি, এখন শুধু গোসল করে দিতে হবে একটা লম্বা ঘুম, তারপর অন্যকথা৷
No comments:
Post a Comment