
সময় সংকোচন করতে গিয়ে রওনা হলাম সন্ধ্যার পর পরই, চাপাতা মেইন ড্রাইভার, আমি ব্যাকআপ, রাতে কম ঝিমাই বলে সুনাম ছিল, সুতরাং ঠিক হলো মাঝরাতের পর থেকে আমি চালাব৷ স্বার্থপর তিন মেয়ে গাড়ি চলা শুরু করার আধ ঘন্টার মধ্যে ভ্যানের পেছনের সিটে ঘুমিয়ে গেল৷ কি আর করা আমরা ছেলে দুজন টুকটাক কথা বলতে লাগলাম, ঘন্টা দুয়েক পরে ড্রাইভার বদলে আমি স্টীয়ারিং এর পেছনে, ততক্ষনে গাড়ির ভেতরটা নিদ্রিতাদের নিঃশ্বাসের শব্দে-গন্ধে বেশ ভারী হয়ে উঠেছে৷ রাত একটার দিকে আমাদের স্টেট পার হয়ে পাশের স্টেটের মোটামুটি সাইজের একটা শহরে পৌছলাম, আর চালাতে পারব না, এখানেই রাতে থাকতে হবে৷ এত রাতে মোটেলওয়ালারা দেখি আকাশচুম্বি ভাড়া চেয়ে বসছে, ঠিক করলাম কি আর করা সবাই একরুমেই থাকব৷
একটা মতলব ছিল মাঝরাতে সবার আগে উঠে একমাত্র বাথরুমটাতে গিয়ে একটু পেট খালি করে নেব, রুমের এটাচড বাথরুম হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে খুব একটা সাউন্ডপ্রুফ না৷ সাতপাচ ভেবে আর ঝুকিটা নিলাম না, যদিও আগ্নেয়গিরি তখন ফুসছে৷ আমাদের সাথের মেয়েরা গতানুগতিক বাঙালী মেয়েদের চেয়ে অনেক চটপটে, অন্তত সময়ের ব্যাপারে, সকালে আমি আড়মোড়া ভাঙ্গতেই দেখি ওরা সেজে গুজে বিছানায় বসে গল্প মারছে৷ আরও ঘন্টাখানেক ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখনও ১০০০ মাইল বাকী, নিজের ওপরই রাগ হলো এত টাইট প্ল্যান করার জন্য৷
মোটেলের ফ্রী মাফিন, আর জুস খেয়ে আমার কাজ হবে না, বের হয়ে ম্যাকডোনাল্ডসে সস্তা মারলাম, তখন তেমন স্বাস্থ্য সচেতন ছিলাম না, সুতরাং ম্যাক আমার ভালই চলতো৷ চাপাতা দেখি সারারাত ঘুমিয়েও আমাকে ড্রাইভ করতে বলে, যদিও মেয়েদের সামনে বীরত্ব ফোটানোর বয়স চলে গেছে, তাও মুখ ফুটে না করতে পারলাম না৷ মেয়েরা দেখি বেশ জলি মুডে আছে, গাড়ি চলতে হাসাহাসি, কথাবার্তা অচিরেই চেচামেচিতে পরিনত হলো৷ এক জায়গায় পড়েছিলাম মেয়েরা গসিপ করে অর্গাজমের সমান মজা পায়, কে জানে, হলেও হতে পারে৷ আর না হলেই কি বেশ মজা যে পাচ্ছে তা তো বোঝাই যায়৷ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের পরচর্চা পর্ব শুনতে৷ পরিচিত, অর্ধ পরিচিত, অপরিচিত বহু কাহিনী শুনলাম৷ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহুত কিছু মিস করেছি আরেকবার উপলব্ধি হল৷

মন্টানার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দিগন্তের উত্তর ধার দিয়ে দেখা যাচ্ছিল গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক৷ গ্লোবাল ওয়ার্মিং সত্যি না মিথ্যা এই নিয়ে মিডিয়াতে অনেক তর্ক হয়৷ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা সরাসরি প্রমান গ্লেসিয়ার পার্ক, গত কয়েক দশকে অল্প সময়েই এর বেশীরভাগ গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) গলে গেছে৷ আর কিছুদিন পর গ্লেসিয়ার পার্কে কোন গ্লেসিয়ারই থাকবে না৷ তবুও অপরাহ্নের আলোতে বরফের সাদা টুপী পড়া নীলাভ পর্বতগুলোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল৷
ইয়োলোস্টোনে পৌছুতে পৌছুতে রাত নেমে গেল৷ মাথা ব্যাথায় তখন আমার অবস্থা কাহিল, তাড়াতাড়ি টুকটাক কিছু খেয়ে একটা টাইলেনল (প্যারাসিটামল) খেলাম৷ ট্যুরিস্টে ছেয়ে গেছে আশে পাশের ছোট শহর গুলো৷ এর মধ্যে আমাদের গাড়ি পড়ল একপাল বাইসনের মধ্যে৷ বাইসনগুলো একটু বুঝদার মনে হয়, কারন চাইলে ওরা ভ্যানটাকে উল্টে দিতে পারত, কিন্তু সেরকম চেষ্টা আছে বলে মনে হয় না, ঢিমেতালে ওরা রাস্তা পার হলে ছাড়া পেলাম, আরও অনেক গাড়ি আমাদের মত আটকে ছিল৷ বাইসন কিন্তু উত্তর আমেরিকা থেকে একরকম নিশ্চিহ্নই হয়ে গিয়েছিল, পরে আবার রি-ইন্ট্রোডিউস করা হয়েছে৷ খুজে পেতে সস্তায় একটা মোটেল পাওয়া গেল, গোটা বিশেক ফোন করতে হয়েছে এটা পেতে, আবার সবাই মিলে একরুমে, তবে আজ আমার রাতে বাথরুমে যেতেই হবে, নইলে…
সকালে তাড়াহুড়ো করে সবাই বেড়িয়ে পড়লাম৷ বহু লোক দেখলাম ক্যাম্পিং করছে পার্কের মধ্যেই, অনেকে আবার আরভি নিয়ে এসেছে, বউ-বাল-বাচ্চা সহ৷ পার্কের সাইজ বেশ বড় ৮৮৭৯ বর্গ কিমি, মানে বাংলাদেশের পুরোনো ময়মনসিংহ-জামালপুর জেলার সমান৷ গাইজারগুলো অদ্ভুত, পানি যেমন ফুটন্ত তেমন আবার সালফার মিশ্রিত৷ পুরো জায়গাটা একরকম বারূদের গন্ধে ভরা৷ একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে এত প্রতিকুল পরিবেশেও গাইজার বা উষ্ঞপ্রস্রবন একদম প্রানহীন নয়৷ সালফার খেকো ব্যাক্টেরিয়া বেচে থাকতে পারে এত তাপমাত্রায়৷ এসব ব্যক্টেরিয়ার শক্তির উত্স জিওথার্মাল এনার্জি, যেখানে জীবজগতের বাকী অংশ ঘুরে ফিরে সুর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল৷ পৃথিবী সৃষ্টির আদি অবস্থায় তার মানে এসব ব্যক্টেরিয়ার বেচে থাকতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়, বিশেষত তখন যেহেতু আগ্নেয়গিরি আরও বেশী ছিল৷



ফেরার পথটা ছিল বোরিং৷ আমি বেশী বুদ্ধি করতে গিয়ে অল্টারনেট রুট নিলাম, প্রায় দুইঘন্টা নষ্ট হলো ওখানে৷ সারারাত বদলাবদলি করে ড্রাইভ করতে হল৷ ১৪০০ মাইল এখন মনে হচ্ছিল ১৪ হাজার মাইল৷ মেয়েরাও ক্লান্ত হয়ে এখন ঘুমাচ্ছে৷ পরের সারাদিন ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে মনে হল অবশেষে মুক্তি, এখন শুধু গোসল করে দিতে হবে একটা লম্বা ঘুম, তারপর অন্যকথা৷
No comments:
Post a Comment