Saturday, December 30, 2006

দাঁতাল বাঘ


হিমু মন্তব্য করেছে একটা পোস্টে আবার বিবর্তন নিয়ে লেখা শুরু করতে, সেও লিখবে বলেছে৷ আসলে বিবর্তনবাদ নিয়ে লেখাগুলোর একটা বড় অংশ কেবল মানুষের বিবর্তন নিয়ে আমরা আলোচনা করি, অথচ বিবর্তন মেকানিজমের দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে মানুষের বিবর্তনের এমন কোন বিশেষত্ব নেই আর দশটা জীবের চেয়ে৷ মানুষকে তৈরী করা বিবর্তনের টার্গেট ছিল না, এখনও নয়, ন্যাচারাল এভ্যুল্যুশনের কোন টার্গেট নেই৷ বিবর্তন এখনও থেমে নেই, প্রতি জেনারেশনেই আমরা, এবং অন্যান্য জীব একটু একটু করে বদলে যাচ্ছি, ন্যাচারাল সিলেকশন (survival of fittest) যেসব জীব তুলনামূলক ভাবে ভালো বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে তাদেরকে টিকিয়ে রাখবে, বাকীরা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷ সমস্যা হচ্ছে ভালো বৈশিষ্ট্যের কোন ইউনিভার্সাল সংজ্ঞা নেই, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে কখন কোনটা সুবিধা পাবে৷ যেমন সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ক্রেটাশাস যুগে ডায়নোসররা তাদের অতিকায় আকৃতির (আরো বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য সহ)কারনে অন্যান্য প্রানীর চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বেশী সুবিধা পাচ্ছিল৷ তখনকার যুগে তারাই সবচেয়ে সফল প্রানী, অথচ যখন একটা গ্রহানু বা ধুমকেতু এসে পৃথিবীকে আঘাত করল (মেক্সিকোর ইউকাটানে) তখন অতিকায় আকৃতি, খাদ্য পিরামিডের চুড়ায় থাকাই তাদের জন্য কাল হল৷ সুবিধা হঠাত্ করে বদলে গেল অসুবিধায়৷ ডায়নোসর সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, প্রায় তের কোটি বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করার পর৷



বেশীরভাগ জীব অবশ্য ডাইনোসরদের মতো নাটকীয় বিলোপের (Mass Extinction) সুবিধা পায় নি৷ Ice Age 2 মুভিটা দেখলাম ওইদিন, প্রথমটাও ভালো লেগেছিল আমার কাছে৷ এই মুভিতে যেসব প্রানী দেখানো হয় এর অনেক গুলোই কিন্তু এখন বিলুপ্ত৷ যেমন হাতির মতো দেখতে চরিত্র Manny আসলে এখনকার সময়ের আফ্রিকান বা ভারতীয় হাতি নয়, বরং বরফ যুগের উলী ম্যামথ (Wooly Mammoth); ম্যামথ আরো ছয় হাজার বছর আগে থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ এই সিনেমার কাহিনী অবশ্য বিশ হাজার বছর আগের৷ অথবা বিরক্তিকর চরিত্র Sid হচ্ছে স্লথ, সম্ভবত মেগাথিরীয়াম (Megatherium) বা জায়ান্ট স্লথ, মূলত উত্তর এবং দক্ষিন আমেরিকার অধিবাসী৷ আর Diego হচ্ছে Saber Toothed Tiger (দাঁতাল বাঘ ) এবং খুব সম্ভব আমেরিকার স্মাইলোডন (Smilodon) প্রজাতি৷




দাঁতাল বাঘের বিশেষত্ব হচ্ছে এদের উপরের চোয়ালের বিশালাকৃতির দুটি দাঁত৷ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এরকম দাঁতওয়ালা বাঘের বেশ কয়েকবার আলাদা ভাবে উদ্ভব হয়েছে, অর্থাত্ একবার এরকম প্রানী উদ্ভব হয়ে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বহু লক্ষ বছর পরে আবার কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের দাঁতওয়ালা প্রানীর উদ্ভব হয়েছে, সময়ের সাথে আবার তারাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাসে এটা ভীষন স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়, এরকম বারবার একই বৈশিষ্ট্য আলাদা প্রানীতে উদ্ভব হওয়া৷ যেমন ৫০ থেকে ১৫ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা এবং এশিয়ায় একরকম দাঁতাল বাঘ ছিল যাদের নাম দেয়া হয়েছে ডাইনোফীলিস (Dinofelis)৷ ডাইনোফীলিস প্রায় আড়াই ফুট লম্বা বাঘ (তার মানে বেশী বড় নয়)৷ আফ্রিকায় এদের অনেক ফসিল (জীবাশ্ম) পাওয়া গেছে, দুঃখজনক হচ্ছে এদের ফসিলের আশে পাশে অনেক অস্ট্রালোপিথেকাসের ফসিলও আছে৷ অস্ট্রালোপিথেকাস ৪০ থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ, আকারে আমাদের এখনকার আকৃতির চেয়ে একটু ছোট৷ অস্ট্রালোপিথেকাসের নামকরা ফসিল হচ্ছে “লুসি”, বিজ্ঞানী ডনাল্ড ইয়োহানসন (Donald Johanson) ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ার হাডার এলাকায় ফসিলটি খুজে পান৷ গৃহযুদ্ধের কারনে অবশ্য লুসির পরে আর খুব বেশী খোজাখুজি চালানো যায় নি ইথিওপিয়ায়৷ পূর্ব আফ্রিকার এই দেশগুলো এক অর্থে আমাদের মাতৃভুমি, আমাদের পুর্বপুরুষরা লক্ষ বছর আগে এখানেই ছিলেন৷ ফসিল আবিস্কারের ধরন, এবং কয়েকটি ফসিলে দাঁতের দাগ দেখে মনে হয় লুসির মতো প্রানীরা ওই সময় ডাইনোফীলিসের সহজ শিকার ছিল৷


প্রায় পচিশ লাখ বছর আগে আমেরিকায় আরেক ধরনের বিশাল আকৃতির দাঁতালো বাঘের উদ্ভব হয়, আগেই উল্লেখ করেছি এর নাম স্মাইলোডন৷ স্মাইলোডনের অসংখ্য ফসিল আছে আমেরিকা জুড়ে৷ গড়ে এদের দাঁতের দৈর্ঘ্য সাড়ে আট ইঞ্চির মতো৷ এত বড় দাঁত ঠিক কি কাজে লাগত বলা মুস্কিল৷ কারন আকারে বড় হওয়ার জন্য এরকম দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী, বিশেষ করে কামড়াতে গিয়ে যদি হাড়ের সাথে সংঘর্ষ হয়৷ স্মাইলোডনের সময় পৃথিবীতে বরফ যুগ চলছিল, এসময় মোটা চামড়া বা পশমী অনেক প্রানীর উদ্ভব ঘটে, যেমন উলী ম্যামথ বা উলী রাইনো (গন্ডার), হতে পারে আট ইঞ্চি লম্বা ধারালো দাত এসব মোটা চামড়ার প্রানী শিকারে সাহায্য করত৷ মানুষ আমেরিকা মহাদেশে পা দেয়ার আগেই সম্ভবত স্মাইলোডন বিলুপ্ত হয়ে যায়, যদিও অনেক সিনেমায় দেখানো হয় স্মাইলোডনের সাথে গুহমানবরা মুখোমুখি হচ্ছে৷

এ মুহুর্তে পৃথিবীতে কোন দাঁতাল বাঘ নেই, তবে ওরা যেহেতু ঘুরে ফিরে বারবার ফিরে আসে, কে জানে পরবর্তি বরফযুগে হয়তো আবার দেখা যাবে৷



ছবিঃ সংগৃহিত

No comments:

 
eXTReMe Tracker